রাজধানীসহ সারা দেশের নামি-দামি স্কুলগুলোর শিক্ষা কার্যক্রম সাধারণত প্রথম শ্রেণি থেকে শুরু হয়। আর বেশির ভাগ সরকারি মাধ্যমিকে কার্যক্রম শুরু হয় তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণি থেকে। ফলে এর আগ পর্যন্ত অভিভাবকদের অন্যতম পছন্দ কিন্ডারগার্টেন স্কুল। মূলত ভালো কিন্ডারগার্টেনে শিশু ভর্তির জন্য নভেম্বর-ডিসেম্বরে লাইন পড়ে যায়। কিন্তু করোনার এই দুঃসময়ে এবারের ছবিটা একেবারেই আলাদা। ভর্তি মৌসুম চলছে, তবে নেই তোড়জোড়। খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না নতুন শিক্ষার্থী। এমনকি টিউশন ফি পরিশোধের ভয়ে যোগাযোগ রাখছেন না আগের শিক্ষার্থীর অভিভাবকরাও। ফলে বছর শেষ হতে চললেও দুরবস্থা কাটিয়ে উঠতে পারছেন না কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষক-কর্মচারীসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
জানা যায়, অভিভাবকরা সাধারণত বাড়ির কাছাকাছি ভালো কিন্ডারগার্টেনে তাঁদের সন্তানদের ভর্তি করান। সাড়ে তিন থেকে চার বছর বয়স হলেও প্লে শ্রেণিতে ভর্তি করিয়ে দেন। এরপর নার্সারি ও কেজি শ্রেণিতে পড়ার পর নামি-দামি স্কুলের প্রথম শ্রেণিতে ভর্তিযুদ্ধে নামেন। ফলে কিন্ডারগার্টেনগুলোর ওপরের শ্রেণিতে শিক্ষার্থী কম থাকলেও প্রথম শ্রেণির আগের তিনটি শ্রেণিতে ভরপুর শিক্ষার্থী থাকে। এমনকি অনেক কিন্ডারগার্টেনে ডিসেম্বর এলেই সিটও পাওয়া যায় না।
রাজধানীর মাটিকাটায় স্কাইলার্ক মডেল স্কুলের শিক্ষার্থী পাঁচ শতাধিক। এর মধ্যে চলতি শিক্ষাবর্ষে বিভিন্ন শ্রেণিতে নতুন ভর্তি হয়েছিল দুই শর বেশি শিক্ষার্থী। কিন্তু আগামী শিক্ষাবর্ষের জন্য এখন পর্যন্ত একজনও নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়নি।
এই স্কুলের অধ্যক্ষ মো. সাফায়েত হোসেন বলেন, ‘প্রতিবছর এই সময়ে দিন-রাত স্কুল সরগরম থাকত। স্কুলে অভিভাবকদের ভিড় লেগেই থাকত। অনেকেই নানা তথ্য জানতে, খোঁজখবর নিতে আসতেন। অনেকেই ভর্তি করাতে আসতেন। কিন্তু এবার কারোর দেখা নেই। এমনকি আমাদের যেসব শিক্ষার্থী রয়েছে, তাদের অভিভাবকদের বারবার এসএমএস দেওয়ার পরও কেউ যোগাযোগ করছেন না। কী করব, সামনে কী হবে কিছুই ভেবে পাচ্ছি না।’
সারজন স্কুল অ্যান্ড কলেজের চট্টগ্রামে চারটি ও ঢাকায় একটি ক্যাম্পাস রয়েছে। প্রতিবছর তাদের পাঁচটি ক্যাম্পাসে নতুন প্রায় ৫০০ শিক্ষার্থী ভর্তি হয়। কিন্তু এবার এখন পর্যন্ত নতুন শিক্ষার্থীর দেখা পায়নি স্কুলটি।
এই স্কুলের প্রধান ও বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ঐক্য পরিষদের চেয়ারম্যান এম ইকবাল বাহার চৌধুরী বলেন, ‘এরই মধ্যে দুই হাজার কিন্ডারগার্টেন বন্ধ হয়ে গেছে। যাদের নিজেদের পুঁজি ছিল, তারা তা ভেঙে কোনো রকমে স্কুল টিকিয়ে রেখেছে। এখন ডিসেম্বর মাস চলছে; কিন্তু শিক্ষার্থীর দেখা মিলছে না। কেউ ভর্তির তথ্য জানতেও আসছে না। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন, আমাদের বাঁচান। অন্তত এক মাসের জন্য হলেও স্কুল খুলে দিন। আমরা ক্লাস-পরীক্ষা কিছুই নেব না। শুধু ভর্তি কার্যক্রমটা চালাই, যাতে আগামী বছর যেন কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলো টিকে থাকতে পারে। ১০ লাখ শিক্ষক-কর্মচারী জীবন ধারণ করতে পারেন।’
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে গত ১৭ মার্চ থেকে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে, আগামী ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত এই ছুটি বলবৎ রয়েছে। এই সময়ে বেশির ভাগ কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষার্থীদের স্কুলের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই। এমনকি মার্চ থেকে কোনো টিউশন ফিও পায়নি স্কুলগুলো। ফলে দেশের প্রায় ৬০ হাজার কিন্ডারগার্টেনের মধ্যে অনেক স্কুল এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। প্রায় ১০ লাখ শিক্ষক-কর্মচারী মানবেতর জীবন যাপন করছেন।
কিন্ডারগার্টেন-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, যেহেতু এখনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ, তাই যেসব অভিভাবক তাঁদের সন্তানদের কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি করাতে চান, তাঁরা এখনো আসছেন না। কারণ আগে ভর্তি করলে যদি টিউশন ফি দিতে হয়। এ ছাড়া বর্তমানে কিন্ডারগার্টেনপড়ুয়া বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই ফেব্রুয়ারি-মার্চ থেকে বেতন দেয়নি। তারাও স্কুলের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখছে না। কারণ তারাও মনে করছে, যোগাযোগ করলে যদি বকেয়া টিউশন ফি দিতে হয়। এ জন্য সবাই সাধারণত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা পর্যন্ত অপেক্ষা করছে। অনেকেই টিউশন ফি দেওয়ার ভয়ে স্কুল পরিবর্তন করে অন্য স্কুলে ভর্তিরও পরিকল্পনা করছে।
কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য মতে, এরই মধ্যে দেশের দুই হাজার কিন্ডারগার্টেন বন্ধ হয়ে গেছে। আগামী শিক্ষাবর্ষে ভর্তিপ্রক্রিয়া চালাতে না পারলে আরো প্রায় ২০ হাজার কিন্ডারগার্টেন বন্ধ হওয়ার শঙ্কা করা হচ্ছে। তবে অনেকেই স্কুল বিক্রির নোটিশ দিলেও সেখানে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। কিন্ডারগার্টেনের ১০ লাখ শিক্ষক-কর্মচারীর বেশির ভাগই পেশা পরিবর্তন করেছে। কেউ কেউ ছোটখাটো নানা কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। আবার কেউ গ্রামে ফিরে গেছেন।
জানা যায়, এ বছর জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি), প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) ও উচ্চ মাধ্যমিক (এইচএসসি) পরীক্ষা নেওয়া হয়নি। স্কুলগুলোতেও বার্ষিক পরীক্ষা হয়নি। এতে কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলো আরো বেশি সমস্যায় পড়ছে। কারণ এসব স্কুলে যেহেতু নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানরা বেশি পড়ে, তাই পরীক্ষা না হওয়ায় কেউ আর টিউশন ফি দিচ্ছে না। আর যখনই স্কুল খুলুক না কেন, অনেকেই টিউশন ফি দেওয়ার ভয়ে অন্য স্কুলে চলে যাবে।