লাশ কাটা ঘরে লাশের সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু সেখানে ময়নাতদন্ত চলে অফিস সময়ের হিসাবে—সকাল থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত। এতে কাজ শেষ হয় না। প্রিয়জনকে সমাহিত করার জন্য শোকের সঙ্গে উদ্বেগ যোগ হয়ে অপেক্ষায় থাকতে হয় স্বজনদের। তাঁদের চোখের জল শুকিয়ে যায়। চরমে ওঠে ভোগান্তি।
এদিকে আইনি সুরাহা না হওয়ায় চারটি লাশ দীর্ঘদিন ধরে মর্গের ডিপ ফ্রিজে রয়েছে। লাশগুলো কিছুটা নষ্টও হয়েছে। এ জন্য মর্গের ডোমদের দৈনন্দিন কাজেও ব্যাঘাত ঘটছে। এ রকম আরো কিছু সমস্যায় বেহাল হয়েছে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের মর্গ।
গত ১০ ডিসেম্বর দুপুরে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ময়নাতদন্তের জন্য নতুন চারটি লাশ রাখা হয়েছে মর্গে। এর মধ্যে একটি ট্রেন দুর্ঘটনায় বেওয়ারিশ লাশ। সে কারণে খোঁজ নেই ওই লাশের স্বজনদের। আর অন্যান্য কারণে নিহত অপর তিনজনের লাশ বাড়ি নিয়ে যেতে স্বজনরা মর্গের বাইরে অপেক্ষা করছেন।
সূত্র জানায়, ঢামেক হাসপাতালের মর্গের পাঁচটি ফ্রিজের মধ্যে তিনটিই নষ্ট। প্রতিটি ফ্রিজের মধ্যে চারটি লাশ রাখার ব্যবস্থা আছে। সক্রিয় দুটি ফ্রিজের একটিতে রয়েছে অমীমাংসিত ওই চার লাশ। তাই যখন লাশের চাপ বেড়ে যায়, তখন গাদাগাদি করে রাখতে হয়।
সমস্যা আরো আছে। লাশ কাটার ঘরে তিনটি এসি নষ্ট। মর্গের ড্রেনেজ ব্যবস্থা ভালো না, অল্প বৃষ্টিতেই পানি উঠে যায়, পুলিশ ডিউটি রুম ও লাশের অভিভাবকদের ওয়েটিং রুমটির নাজুক অবস্থা। তাই এগুলোর সংস্কার করাও জরুরি।
সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত ময়মনসিংহ গৌরীপুরের আসমা বেগমকে (৪০) ঢামেক হাসপাতালে আনার পর ৯ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় মারা যান। সন্ধ্যায় মারা যাওয়ায় ওই রাতে আর ময়নাতদন্ত করাতে পারেননি স্বজনরা। হাসপাতালের করিডরে রাত পার করেছেন। পরদিন স্বজনরা জানান, দুপুর ১টার সময় লাশ মর্গে রাখা হয়েছে। কখন ডাক্তার আসবেন, পোস্টমর্টেম করার পর লাশ নেবেন তার অপেক্ষা করছেন তাঁরা। আসমার ছোট বোন শামীমা আক্তার ললিতা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘গতকাল এই মেডিক্যালে আমার বুজি মারা গেছে; তাকে মেরে ফেলা বাসটিও আটকানো হয়েছে। মামলা হয়েছে। এ জন্য পোস্টমর্টেম ছাড়া লাশ দিচ্ছে না। আমরা সকাল থেকেই বসে আছি, এখন যে কী হয় বুঝতে পারছি না।’
ময়নাতদন্ত কেন রাতে করে না সে প্রশ্নও করেন ললিতা। বলেন, ‘রাতেই সেটা করে ফেললে আমাদের কষ্ট অনেক কমত।’ রাজধানীর উত্তরায় ছুরিকাঘাতে খুন হওয়া কলেজছাত্র জিসান হাবিবের আত্মীয়রাও বলেন, পোস্টমর্টেম করার সময় বাড়ালে খুব উপকার হবে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ডাক্তার ও ডোমদের জন্য অতিরিক্ত সময়ের জন্য সম্মানীর ব্যবস্থা করে রাত ৯টা পর্যন্ত পোস্টমর্টেম করা গেলে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা লাশের স্বজনদের ভোগান্তি অনেকটা কমত।
জানা যায়, পাঁচ বছর ধরে ডিপ ফ্রিজে রয়েছে খোকন নন্দী ওরফে রাজীব চৌধুরী নামে এক ব্যক্তির লাশ। এই লাশের দাবিদার দুই ধর্মের দুই স্ত্রী। আদালত এখন পর্যন্ত সিদ্ধান্ত দেননি খোকন নন্দী ওরফে রাজীব চৌধুরী কোন ধর্মের ছিলেন। আদালতের সিদ্ধান্ত মোতাবেক যেকোনো এক স্ত্রীর কাছে লাশটি হস্তান্তর করা হবে। পরে ধর্মীয়ভাবে লাশটির কবর বা সৎকার করা হবে।
পাঁচ বছর ধরে আরো একটি লাশ মর্গে রয়েছে, যেটি দক্ষিণ আফ্রিকার এক নারীর। প্রেমের টানে বাংলাদেশের কুমিল্লায় এসে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেন তিনি। এ ছাড়া এক আমেরিকানের লাশ চার বছর ধরে রাখা রয়েছে ফ্রিজে। কারাবন্দি হাজতি ভারতীয় নাগরিক মানিকাণ্ডার লাশ আছে ২৯ জুলাই থেকে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, রাষ্ট্রপক্ষ এই লাশগুলোর ব্যাপারে সুরাহা করলে মর্গ কর্তৃপক্ষের জন্য বাড়তি চাপ কমবে। লাশগুলোর ব্যাপারে পুলিশ, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দূতাবাসের উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।
কালের কণ্ঠ’র অনুসন্ধানে জানা যায়, ঢামেক হাসপাতালের মর্গে আগে প্রতিদিন গড়ে আট থেকে ১০টি পোস্টমর্টেম হলেও এখন তা অর্ধেকে নেমে এসেছে। বিষ খাওয়া, ফাঁসি ও সড়ক দুর্ঘটনা, এমনকি মার্ডারের অনেক লাশ ময়নাতদন্ত ছাড়াই পুলিশ ক্লিয়ারেন্স নিয়ে স্বজনদের কাছে দেওয়া হয়। এই মর্গে আসা বেওয়ারিশ লাশগুলো পোস্টমর্টেম করিয়ে স্বজনদের জন্য তিন-চার দিন অপেক্ষার পর আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ১০ ডিসেম্বর ঢামেকের মর্গ থেকে তিনটি লাশ তাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। আগে আঞ্জুমান মুফিদুলকে কর্তৃপক্ষ লাশের ছবি হস্তান্তর করত না। এখন লাশের সঙ্গে ছবি দিয়ে দেওয়া হয়, যাতে স্বজনদের লাশ খুঁজে পেতে সহজ হয়।
ঢামেক মর্গের মরচুয়ারি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেকান্দার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পুরনো চারটি লাশ হস্তান্তর করতে পারলে আমাদের জন্য ভালো হতো। পাঁচটি ফ্রিজের মধ্যে তিনটি নষ্ট থাকায় লাশ বেড়ে গেলে এগুলো নিয়ে অনেক সময় বিপাকে পড়তে হয়। এ ছাড়া আমাদের ড্রেনেজব্যবস্থা, পুলিশের ডিউটি রুম ও লাশ কাটার ঘরে এসিগুলো সংস্কার করতে ওপর মহলের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।’
সেকান্দারসহ মর্গে বেতনভুক্ত কর্মী রয়েছেন দুজন। আর তিনজন পুরুষ ও দুজন নারী আছেন মর্গ সহকারী হিসেবে। তাঁরা পুলিশ এবং লাশের আত্মীয়-স্বজন থেকে বকশিশ পেয়ে চলেন।
মর্গের সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ঢামেক হাসপাতালের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রধান ডা. সোহেল মাহমুদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আদালত পুরনো চারটি লাশের বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে লাশ হস্তান্তর করলে আমাদের জন্য অনেক ভালো হয়। নষ্ট ফ্রিজ ও এসি সারানোর জন্য কর্তৃপক্ষকে বারবার বলা হলেও এখনো এর কোনো সুরাহা হয়নি। এসব কারণে আমাদের দৈনন্দিক কাজের ব্যাঘাত ঘটছে।’
পোস্টমর্টেমের সময় বাড়ানো নিয়ে সোহেল মাহমুদ বলেন, ‘নানা সীমাবদ্ধতা ও সমস্যার মাঝেও ডাক্তাররা ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন। কর্তৃপক্ষ যদি মনে করে জনসাধারণের ভোগান্তি কমবে, তাহলে ডাক্তারদের জন্য সম্মানীর ব্যবস্থা রেখে সময় বাড়ালে তাঁরা কাজ করতে অবশ্যই আগ্রহী হবেন।’