এত দিন দেশে করোনাভাইরাসের টিকা আমদানি শুধু সরকারি ব্যবস্থাপনার মধ্যে রাখার দিকে বেশি নজর ছিল; এখন সেখান থেকে সরে আসতে চায় সরকার। অনেকটা হঠাৎ করেই সরকারের দিক থেকে টিকা আমদানির জন্য বেসরকারি খাতকে ডাকাডাকি শুরু হয়েছে। অবশ্য এ ক্ষেত্রে প্রধানত দুটি শর্ত দেওয়া হচ্ছে। একটি হচ্ছে—যে টিকাই আনা হবে, সেটা হতে হবে যুক্তরাষ্ট্রের ওষুধ প্রশাসন (এফডিএ), যুক্তরাজ্য, জাপান ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সংশ্লিষ্ট সংস্থা কিংবা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার যেকোনো এক বা একাধিক সংস্থা থেকে অনুমোদিত। আর দ্বিতীয় অপরিহার্য শর্ত হচ্ছে বাংলাদেশের ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের নির্দিষ্ট কমিটি থেকে অনুমোদন নেওয়া।
যদিও এ বিষয়ে কেউ কেউ বলছেন, বেসরকারি খাতকে টিকা নিয়ে নতুন ব্যবসার দরজা খুলে দেওয়া হচ্ছে। দাম নিয়ে আরেক ধরনের নৈরাজ্য বা বিশৃঙ্খলা ও হয়রানির আশঙ্কা করছেন তাঁরা। আবার কেউ কেউ বলছেন, এখন টিকা নিয়ে যতটা আগ্রহ দেখা যাচ্ছে, দেশে টিকা আসার পর মানুষের মধ্যে এই আগ্রহ ও কৌতূহল কমে যেতে পারে।
জানতে চাইলে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. আব্দুল মান্নান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সরকারিভাবে আমরা টিকা সংগ্রহের সার্বিক ব্যবস্থা নিয়েছি। এখন চলছে চূড়ান্ত প্রস্তুতি। এখন টিকা দেশে কবে আসবে আমরা সেই অপেক্ষায় আছি। তবে এখন আমরা মনে করছি সরকারের একার পক্ষে সব সামাল দেওয়া কঠিন। তাই আমরা প্রাইভেট সেক্টরকেও এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছি। কোনো বেসরকারি উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান সরকারি নিয়মনীতি অনুসরণ করে টিকা আনতে চাইলে সেটাকে আমরা স্বাগত জানাব।’
গতকাল রবিবার টিকাসংক্রান্ত উচ্চপর্যায়ের এক বৈঠকেও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে টিকা আমদানির জন্য নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় এগিয়ে আসার জন্য উৎসাহিত করতে বলা হয়েছে।
অন্যদিকে গতকাল সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক ওয়েবিনারেও বেসরকারি খাতকে দ্রুত সময়ের মধ্যে টিকা আনার সুযোগ দেওয়ার ব্যাপারে গুরুত্ব দেওয়া হয়।
সরকারের বাইরে থাকা বিশেষজ্ঞরাও এ বিষয়ে সরকারের ওপর এক ধরনের চাপ সৃষ্টি করে আসছিলেন কিছুদিন ধরেই।
গতকাল প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব ড. আহমদ কায়কাউস বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। সেই বৈঠকে উপস্থিত একাধিক সূত্র কালের কণ্ঠকে জানায়, বৈঠকে করোনার টিকাকেন্দ্রিক যাবতীয় কার্যক্রম নিয়ে আলোচনা হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর ও বিশেষজ্ঞ কমিটির পক্ষ থেকে তুলে ধরা বিভিন্ন বিষয় বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। আজ-কালের মধ্যেই তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস) শাখাকে ডাটাবেইস তৈরি ও আপডেট করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যাতে পূর্বনির্ধারিত ক্যাটাগরি অনুসারে যারা টিকা পাবে তাদের টিকা প্রয়োগে শৃঙ্খলা রক্ষা করা সহজ হয়। এ ক্ষেত্রে কোনো সেক্টরের তালিকা যদি বাদ পড়ে থাকে তাও হালনাগাদ করে ফেলতে বলা হয়েছে।
বৈঠকে অন্যদের সঙ্গে ছিলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এ বি এম খোরশেদ আলম। জানতে চাইলে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘টিকা দিতে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) লাগবে। প্রত্যেকের এনআইডি কার্ডের সঙ্গে তথ্য হালনাগাদ রাখতে হবে। কেউ যদি নিজে অ্যাপসের মাধ্যমে টিকা গ্রহণে অসুবিধা মনে করেন বা না পারেন, তবে সে ক্ষেত্রে অন্য কারো কিংবা সরকারের নির্দিষ্ট কর্মীরা তাঁদের সহায়তা করবেন বলে বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে।’
মহাপরিচালক বলেন, ‘বৈঠকে বেশ শক্তভাবেই বলা হয়েছে, বেসরকারি কোনো কম্পানি কোনো টিকা দেশে আনার পর তা বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানে নিয়ে প্রয়োগ করতে পারবে না। সরকারি জনবল দিয়ে সরকারের আওতায় থাকা কোনো ব্যবস্থাপনার অধীনে দিতে হবে।’
বৈঠকের একটি সূত্র জানিয়েছে, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা অন্য কোথাও অনুমোদনের আগে যদি ভারতে অনুমোদন দেওয়া হয়, তখন বাংলাদেশ কী করবে—এমন প্রশ্ন তোলা হয়েছিল। কিন্তু এ বিষয়টির কোনো সদুত্তর মেলেনি মুখ্য সচিব বা দায়িত্বশীল পর্যায় থেকে। বরং এক ধরনের এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে অবশ্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, ‘বৈঠকের আলোচনা অনুসারে জানতে পেরেছি, বড়দিনের উপহার হিসেবেই অনুমোদন পেতে যাচ্ছে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা। এর আগে ভারতে অনুমোদন পেলে কী হবে সে বিষয়ে কোনো নির্দেশনা আসেনি।’
করোনাভাইরাসের টিকা অনুমোদনসংক্রান্ত সরকার গঠিত জাতীয় কারিগরি উপদেষ্টা গ্রুপের (নাইটেগ) একজন জ্যেষ্ঠ সদস্য কালের কণ্ঠকে বলেন, সরকার নিজেদের নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারবে কী পারবে না, তা নিয়ে শঙ্কায় থাকার কারণে এখনই বেসরকারিভাবে টিকা আমদানি বা প্রয়োগের অনুমোদন দেওয়ার পক্ষে ছিল না। তবে তাঁরা সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন যে বেসরকারি খাতের জন্য দুয়ার খুলে দিলে সরকারের যেমন লাভ হবে, তেমনি মানুষেরও লাভ হবে।
জাতীয় স্বাস্থ্য আন্দোলনের সভাপতি বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ ই মাহবুব কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘করোনার টিকা নিয়ে স্বাস্থ্য খাতসহ অন্যান্য খাতের মতোই এক ধরনের নৈরাজ্য, বাণিজ্য, হয়রানি ও দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ন ঘটবে বলে আমার ধারণা। তার পরও বলব, টিকা আমদানির বিষয়টি শুধু সরকারের হাতে আটকে রাখা ঠিক হবে না। আমরা আগে থেকেই বলে আসছি, এটি উন্মুক্ত করে দিলে সরকারের ওপর দেশের বিত্তবান শ্রেণির আগ্রহী মানুষের চাপ কমবে। বিত্তবানরা তখন গরিবের টিকায় ভাগ বসাতে আসবে না। এতে পরোক্ষভাবে গরিবের উপকার হবে। তবে নিয়ন্ত্রণ অবশ্যই সরকারের হাতেই রাখতে হবে, যাতে নৈরাজ্য ঠেকানো যায়।’
নাইটেগের একজন সদস্য বলেন, সরকার যদি বেসরকারি খাতকে করোনার টিকা আমদানির অনুমোদন দিয়ে আবার তা বেসরকারি পর্যায়ে প্রয়োগের সুযোগ না দেয় তবে খুব একটা সুফল মিলবে না। এতে বরং আরেক ধরনের বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা রয়েছে।