করোনা শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত ৪০ হাজার নারী অভিবাসী দেশে ফিরেছেন বলে জানিয়েছে বাংলাদেশী অভিবাসী মহিলা শ্রমিক এসোসিয়েশন (বমসা) নামের একটি সংগঠন। শনিবার ঢাকা রিপোটার্স ইউনিটিতে করা এক সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের পরিচালক ফরিদা ইয়াসমিন এ তথ্য তুলে ধরেন। তারা বলছেন, ১৯৯১ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত মোট ৯,০২,৪৮১ জন মহিলা অভিবাসী কাজের সন্ধানে অভিবাসন করেছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশী গিয়েছেন সৌদি আরবে (৩৭.৭৯ শতাংশ)। এদের বেশীর ভাগ গৃহ শ্রমিক হিসাবে অভিবাসন করেছে। দেশে এবং গন্তব্য দেশে এ সকল নারী অভিবাসীদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। করোনাকালে মোট পুরুষ অভিবাসী ফিরেছেন ২ লাখ ৮৭ হাজার।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ৪০ হাজার মহিলা অভিবাসী শ্রমিকের মধ্যে ১৭ হাজার ৩০০ ফিরে এসেছে সৌদি আরব থেকে। এদের অধিকাংশ ফিরে এসেছে খালি হাতে কিংবা পাওনা বেতনের চেয়ে কম বেতন নিয়ে। অনেকেই বলেছে তারা বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের শিকার। মহিলা অভিবাসীরা তাদের সমস্যা তুলে ধরতে গিয়ে বলেন, সচেতনতা এবং অজ্ঞতার কারণে দালাল বা প্রতারকের পাল্লায় পড়ে কিশোরী মেয়েরা অভিবাসনের নামে পাচার হয়ে যায় এবং কেউ কেউ আবার লাশ হয়ে ফেরত আসে। আমাদের দেশের শ্রম আইন এদের কোনো স্বীকৃতি নেই, নেই কোনো সুরক্ষা বা রক্ষাকবচ এবং গন্তব্য দেশের শ্রম আইনেও এদের কোনো কভারেজ নেই। নারী অভিবাসীদের পাঠানো হয় দ্বিপাক্ষীয় চুক্তি বা সমঝোতা স্বারকের মাধ্যমে যেখানে ১৯৯০ আন্তর্জাতিক সনদের কোন ভূমিকা নেই বললেই চলে। এরচেয়েও বড় এবং ভয়ঙ্কর সমস্যা হলো স্পন্সরসীপ ব্যবস্থা। এ প্রক্রিয়ায় কর্মীর সকল খরচ বহন করে নিয়োগকারী এবং চুক্তিপত্রে যথেষ্ট সুরক্ষা ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা না থাকায় এদেরকে ক্রীতদাসের মত ব্যবহার করা হয়। ২০১৩ সালের বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসী আইনে এ সকল নারী অভিবাসী শ্রমিকের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চত করার কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি।
সংবাদ সম্মেলনে তুলে ধরা তথ্য অনুযায়ী, বমসা প্রতিদিন ২টি হটলাইনের মাধ্যমে দেশ বিদেশ থেকে গড়ে ১৫-২০টি ফোন গ্রহণ করে। এর মাধ্যমে বিভিন্ন অভিযোগ পায় যেমন- ফলপ্রসু সুরক্ষা ও নিরাপত্তা বিধানের অভাবে আমাদের নারী শ্রমিকরা বিরতিহীনভাবে দীর্ঘ সময় কাজ করতে ও এক বাসার পরিবর্তে ২-৩ বাসায় কাজ করতে বাধ্য হয়, এক কাজের কথা বলে অন্য কাজ করতে বাধ্য হয়, বেতন কম দেয়, সময়মত বেতন দেয় না, দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকা, অবসর-বিনোদনের কোন সুযোগ না থাকা, দেশে যোগাযোগ করতে না দেয়া, বাথরুমে আটকে রাখা, নিরাপত্তাহীনতা এবং সুরক্ষার অভাবের কারনে শারীরিক, মানসিক, কখন ও কখনও যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়া, নিখোঁজ কিংবা হত্যার শিকার হওয়া।
ওয়েজ আর্নার কল্যান বোর্ডের তথ্য মতে জানুয়ারী থেকে সেপ্টেম্বর ২০২০ পর্যন্ত ৬৪ জন নারী অভিবাসীর মৃতদেহ তাদের পরিবারের সদস্যগণ গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে ২২টি এসেছে সৌদি আরব থেকে, ১৪টি লেবানন থেকে, ১১টি জর্ডান থেকে, ৭টি ওমান ও ৪টি আরব আমিরাত থেকে। ২০১৬ থেকে সেপ্টেম্বর ২০২০ পর্যন্ত মোট ৪৭৩টি নারী অভিবাসীর মৃতদেহ ফেরত এসেছে এর মধ্যে ১৭৫টি এসছে শুধু সৌদি আরব থেকে । এর মধ্যে বা²ণবাড়িয়ার ১৪ বছরের কিশোরী উম্মে কুলসুম ( ১২ সেপ্টেম্বর ২০২০), ১৩ বছরের নদীর ঘটনা (৩০ অক্টোবর ২০২০), মঞ্জুয়ারী (৩ সেপ্টেম্বর ২০২০) নির্মম হত্যাকান্ডের কথা ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছে। যাদের লাশ আসার পর বিনা পোস্ট মর্টেমে দাফন করা হয়েছে।
বমসার পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিকট আবেদন জানিয়ে তারা বলেন, যেহেতু বাংলাদেশ ১৯৯০ সনের আন্তর্জাতিক সনদ বা চুক্তির একটি পক্ষ রাষ্ট্র তাই অনতিবিলম্বে নারী অভিবাসনের অন্তরায় এ সকল বাঁধা দূর করার জন্য ২০১৩ সালের বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসী আইনের সংশোধন করে নিরাপদ অভিবাসনের মাধ্যমে নারী অভিবাসী শ্রমিকের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার বিধান অন্তর্ভুক্ত করার ব্যবস্থা নেওয়া। বাধ্যতামূলকভাবে প্রত্যেকটি মৃতদেহের পোস্টমর্টেম এর মাধ্যমে মুত্যৃর কারণ চিহ্নিত নিশ্চিত করা এবং এ ব্যাপারে দূতাবাসের পদক্ষেপ মনিটরিং ও জবাবদিহীতা নিশ্চিত করা। যে সকল ব্যক্তির দায়িত্ব অবহেলার প্রমান পাওয়া যাবে তাদের জবাবদিহিতা এবং শাস্তি নিশ্চিত করা। ন্যায় বিচারের স্বার্থে গন্তব্য দেশে যে সকল মামলা দায়ের হয়েছে দূতাবাসের মাধ্যমে সে সকল মামলার ফলোআপ ও মনিটরিং ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। সর্বোপরি বাংলাদেশে সরকারের এ ধরণের হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স নীতি’ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা।
এ ছাড়া বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে অনতিবিলম্বে ২০১৮ সালের ওয়েজ আর্নার কল্যান বোর্ড এক্টের ৯ (খ) ধারা অনুযায়ী দেশে প্রত্যাগত নারী অভিবাসী কর্মীদের সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে পুনর্বাসন ও পূনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য আলাদা প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে নারী অভিবাসী ও তাদের পরিবারে কল্যান নিশ্চিত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করার দাবি তাদের। সেই সঙ্গে করোনাকালে অভিবাসীদের উপর পড়া প্রভাব মোকাবিলায় অভিবাসীদের জন্য বরাদ্দকৃত ৭০০ কোটি টাকার সুবিধা যেন প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তরা পান সে বিষয়ে জোর দাবি তুলে ধরেন বমসা নেতৃবৃন্দ।