নাম তার ‘বে ওয়ান’। পাঁচতারা মানের জাহাজ। আধুনিক বিলাসবহুল যাত্রীবাহী এই জাহাজ সংযুক্ত হলো দেশের সমুদ্রপথে। কক্সবাজার-সেন্ট মার্টিন রুটে যাত্রা শুরু করল এই জাহাজ। এই রুটে নীল সাগরের ঢেউ দেখতে দেখতে পর্যটকদের যাতায়াতের জন্য অত্যাধুনিক এই ক্রুজশিপ সংযোজন করেছে চট্টগ্রামের প্রতিষ্ঠান কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্স।
গতকাল রবিবার বিকেলে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী এবং বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ পারে আনোয়ারায় কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্সের জেটিতে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন জাহাজটি। এরপর এটি প্রায় দুই হাজার পর্যটক নিয়ে কক্সবাজারের উদ্দেশে চট্টগ্রাম ছেড়ে যায়।
জাহাজের বিলাসবহুল একটি কেবিনে কিং সাইজের বিছানায় স্কুলপড়ুয়া আদনান ও আরিফ দুই ভাই খুশিতে লাফাচ্ছিল। তাদের জীবনের প্রথম সমুদ্রযাত্রা। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষের জানালার পর্দা সরিয়ে তাদের মা উপকূলের পানে তাকিয়ে ছিলেন মুগ্ধ হয়ে। এ সময় জাহাজের ডেকে চলছিল সংগীত পরিবেশনা। এ ছাড়া মনোমুগ্ধকর জাদু পরিবেশনা ছিল শিশু যাত্রীদের আকর্ষণের জন্য। শীতের আমেজ কাটাতে কফির জন্য অনেকেই জাহাজের শেষ প্রান্তে লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন।
বে ওয়ান জাহাজের চিফ অফিসার সাইদুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে জানান, আজ সোমবার থেকে কক্সবাজার-সেন্ট মার্টিন রুটে নিয়মিত চলাচল করবে জাহাজটি। পর্যটকদের সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার জন্য জাহাজে রয়েছে নানা আয়োজন। দেশে এটাই প্রথম পাঁচতারা মানের যাত্রীবাহী জাহাজ।
কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্সের কর্মকর্তারা জানান, সর্বনিম্ন দুই হাজার টাকা দামের আসন থেকে শুরু করে ৩০ হাজার টাকা দামের প্রেসিডেন্ট স্যুটের ব্যবস্থা রয়েছে এই জাহাজে। এতে ১৬টি ভিভিআইপি কেবিন, ২৮টি ডিলাক্স কেবিনের পাশাপাশি সাত শতাধিক বিভিন্ন মানের আসন (চেয়ার) রয়েছে।
কক্সবাজারে পর্যটন ব্যবসায় জড়িত আজমল হুদাও বে ওয়ান জাহাজের প্রথম যাত্রার অংশীদার হন যাত্রী হিসেবে। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, দেশের পর্যটনশিল্পে নতুন মাত্রা যুক্ত করতে যাচ্ছে এই বিলাসবহুল ক্রুজশিপ। সাগরপথে বিলাসবহুল ভ্রমণের জন্য এত দিন অত্যাধুনিক কোনো বড় ক্রুজশিপ ছিল না দেশে। এখন একসঙ্গে দুই হাজার যাত্রী পরিবহনের সক্ষমতা গড়ে উঠল।
দেশের ব্লু ইকোনমিতে ‘বে ওয়ান’ নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে উল্লেখ করে সাখাওয়াত হোসেন নামের এক পর্যটক বলেন, ‘প্রতিবেশী দেশগুলোর মতো আমাদেরও সুযোগ রয়েছে সাগরকেন্দি ক পর্যটনশিল্প গড়ে তোলার। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আমাদের পর্যটনশিল্প সবচেয়ে পিছিয়ে। সাগরকেন্দি ক পর্যটনশিল্প বিকাশে সরকার একটু আন্তরিক হলে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ার মতো আমাদের দেশেও আসবে বিদেশি পর্যটক।’
বে ওয়ান দেশের পর্যটনশিল্পের মাইলফলক হিসেবে কাজ করবে উল্লেখ করে তরুণ পর্যটন ব্যবসায়ী মো. সাবাব হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘শুধু কক্সবাজার-সেন্ট মার্টিন রুটে নয়, বরিশাল, সুন্দরবন রুটেও বিলাসবহুল ক্রুজশিপ পরিচালনা করা যেতে পারে। দেশের মানুষ বিনোদনের জন্য পর্যটক হয়ে বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করছে। কিন্তু আমাদের দেশের পর্যটনশিল্প পিছিয়ে আছে। দেশে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা গড়ে উঠলে পর্যটনশিল্প এগিয়ে যাবে।’
জাহাজের বর্ণনা
জাপান থেকে আমদানীকৃত এমভি বে ওয়ান জাহাজটির দৈর্ঘ্য ৪০০ ফুট ও প্রস্থ ৫৫ ফুট। এর গভীরতা ৫.৪ মিটার। জাহাজটির ধারণক্ষমতা ৫০১৯ মেট্রিক টন, জাহাজটিতে মোট ১১২০০ বিএইচপিসম্পন্ন মেইন ইঞ্জিন রয়েছে, যা দিয়ে জাহাজটি প্রতি ঘণ্টায় ২৪ নটিক্যাল মাইল গতিতে ছুটতে পারে। তবে সেন্ট মার্টিন রুটে এটি ১৮ থেকে ২০ নটিক্যাল মাইল গতিতে চলবে। উত্তাল সমুদ্রের ঢেউ মোকাবেলায় জাহাজটিতে ফিন স্ট্যাবিলাইজার সংযুক্ত রয়েছে।
ছয়তলাবিশিষ্ট এই জাহাজের প্রথম তলায় রয়েছে ১২টি ভিভিআইপি কেবিন এবং দুটি রয়াল স্যুট, দ্বিতীয় তলায় (বি-ডেক) আটটি প্রেসিডেন্ট স্যুট ও ৯টি রয়াল স্যুট কেবিন। সি-ডেকে অর্থাৎ তৃতীয় তলায় এক্সিকিউটিভ বাংকার স্যুট ও রয়াল স্যুট, প্রথম শ্রেণির চেয়ার রয়েছে চতুর্থ তলায় বা ডি ডেকে। সাধারণ চেয়ার রয়েছে ই এবং এফ ডেকে। এ ছাড়া জাহাজের বিভিন্ন তলায় রয়েছে রেস্টুরেন্ট।
প্রতিদিন সকাল ৮টায় কক্সবাজার শহরের নুনিয়ারছড়ার বিআইডাব্লিউটিএ ঘাট থেকে যাত্রী নিয়ে সেন্ট মার্টিনের উদ্দেশে রওনা দেবে জাহাজটি। আর সেন্ট মার্টিন পৌঁছাবে সকাল ১১টায়। আবার সেন্ট মার্টিন থেকে বিকেল ৪টায় ছেড়ে সন্ধ্যা ৭টায় কক্সবাজার পৌঁছাবে।